বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০২:০৩ পূর্বাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
বই সংগ্রহ ও জ্ঞানচর্চার জন্য যুগে যুগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য পাঠাগার। পাঠাগার মুসলিম ঐতিহ্যের অংশ। কয়েক শতাব্দী আগে চালু হওয়া পাঠাগারগুলো ছড়িয়ে আছে বিশ্বময়।
নানা প্রান্তের নয়টি ইসলামি পাঠাগার নিয়ে লিখেছেন মুফতি এনায়েতুল্লাহ
হাউজ অব উইজডম
মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থাগার হলো- বায়তুল হিকমা।
অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সাড়া জাগানো ও প্রভাবশালী জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র এটি। যাকে হাউজ অব উইজডম বা জ্ঞানের ভা-ার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অনুবাদকেন্দ্র হিসেবে যাত্রা শুরু হলেও ক্রমেই তা গবেষণাকেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মানমন্দিরে পরিণত হয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় আব্বাসীয় শাসনামলে। খলিফা হারুন-অর-রশিদ আব্বাসীয় রাজধানী বাগদাদে এটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার ছেলে খলিফা আল মামুন ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে সেটির পূর্ণতা দান করেন। তৎকালীন মুসলিম সভ্যতার রাজধানী বাগদাদ ছিল পৃথিবীর শিক্ষা ও সংস্কৃতির লালনক্ষেত্র। আব্বাসীয় খলিফা আল মুনসুর সে সময় বইয়ের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট ছিলেন এবং বই সংগ্রহ করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হারুন-অর-রশিদ বই সংগ্রহ করে সেটিকে একটি লাইব্রেরি হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তখন এর নাম ছিল ‘খাজানাতুল হিকমাহ।
’ পরে মামুনের সময় এটির সংগ্রহশালা এতই বৃদ্ধি পায় যে তিনি এই ভবন বিশাল আকারে সম্প্রসারণ এবং বিষয়ভিত্তিক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন।
বায়তুল হিকমা
মিসরের রাজধানী কায়রোতে অবস্থিত বায়তুল হিকমাও মুসলিম বিশ্বের অন্যতম জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র। ৯৮৮ সালে ফাতেমি খলিফা আল আজিজ এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই পাঠাগারে এক লাখের মতো বই ছিল। ফাতেমিদের পাঠাগারের বিশালতা নিয়ে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে আবি শামা রাওজাতাইন ফি আখবারিদ দাওলাতাইন গ্রন্থে লিখেন, এটা ছিল তৎকালের ‘সপ্তাশ্চর্যের’ একটি। কথিত আছে, কায়রোর রাজপ্রাসাদে (ফাতেমিদের রাষ্ট্রীয় ভবনে) এত বিশাল পাঠাগার ছিল যে, তৎকালে এর কোনো নজির ছিল না। এই পাঠাগারের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল মূলকপির আধিক্য। একেকটা কিতাবের শতাধিক নুসখাও মজুদ ছিল। কথিত আছে, এক তাফসিরে তাবারিরই বারোশ’ নুসখা (মূলকপি) ছিল। নুসখার আধিক্যের মতো মূল গ্রন্থের সংখ্যাও অনেক ছিল।
মদিনা লাইব্রেরি
আধুনিককালে আরবিতে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারকে ‘খাজানাতুল কুতুব’ (বইয়ের ভাণ্ডার) বলে অভিহিত করা হয়। মদিনার প্রাণকেন্দ্র মসজিদে নববির লাইব্রেরিটিও তেমন। এটি ‘মদিনা লাইব্রেরি’ নামেও পরিচিত। ‘খাযাইনুল কুতুবিল আরাবিয়্যাহ’ গ্রন্থের লেখকের মতে, গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৮৮৬ হিজরির ১৩ রমজানের অগ্নিকা-ের আগে। সে হিসেবে এই লাইব্রেরির বয়স সাড়ে পাঁচশ’ বছরের বেশি।
অগ্নিকা-ের ঘটনায় অনেক মূল্যবান কিতাব ও পা-ুলিপি পুড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সৌদি শাসনামলে ১৩৫২ হিজরিতে উবায়েদ মাদানির পরামর্শে ‘মাকতাবাতুল মাসজিদিন নাবাবি’ পাঠাগারের আধুনিক যাত্রা শুরু হয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত গ্রন্থাগারটি মসজিদে নববির অভ্যন্তরে বাবে উমর ও বাবে উসমান সংলগ্ন স্থানে দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। পরে স্থানান্তর করে পশ্চিম দিকে ১২ নম্বর গেট সংলগ্ন ছাদে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনায় সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্তভাবে সাজানো হয়। বর্তমানে এই লাইব্রেরিতে প্রায় লাখখানেক বই, কয়েক হাজার সাময়িকী, বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ঐতিহাসিক অসংখ্য পা-ুলিপি এবং কোরআনে কারিম ও অসংখ্য কিতাবের মূল পান্ডুলিপি রয়েছে। এসব পান্ডুলিপির মূলকপির পাশাপাশি মাইক্রোফিল্ম ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আছে অডিও লাইব্রেরি। এটি মূলত মসজিদে নববি ও মসজিদে হারামের ইমাম-খতিবদের কোরআন তেলাওয়াত, জুমার খুতবা ও ওয়াজ-নসিহতের বিশাল সংগ্রহশালা। এই লাইব্রেরিতে বিশেষ কিছু কিতাব রয়েছে যা একান্ত প্রয়োজনীয় এবং বিশেষ গবেষক ছাড়া অন্য সবার জন্য দেখার অনুমতি নেই।
মদিনায় অবস্থিত আরেকটি বিখ্যাত পাঠাগারের নাম ‘মাকতাবাতুল মালিক আবদুল আজিজ। ’ পা-ুলিপি সংগ্রহের আধিক্যের কারণে এই লাইব্রেরিকে ‘পান্ডুলিপিকেন্দ্র’ বলা হয়। এখানে প্রায় আঠারো (২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৭,৭২২টি) হাজার মূল পান্ডুলিপি রয়েছে। ১৯৭৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মসজিদে নববির পশ্চিম বারান্দা সংলগ্ন স্থানে গ্রন্থাগারটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ। ১৯৮২ সালের ২ নভেম্বর লাইব্রেরিটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ।
চারতলা বিশিষ্টি এই গ্রন্থাগারে রয়েছে কোরআনে কারিমের পা-ুলিপির এক বিশাল সংগ্রহ, যার সংখ্যা প্রায় ১৮৭৮টি। সঙ্গে রয়েছে ৮৪টি হস্তলিখিত কোরআনের বিশেষ অংশ। এসব পা-ুলিপি কোরআনে কারিম পঠন-পাঠন, অনুবাদ ও মুখস্থ করাসহ সার্বিক অবদানের সাক্ষ্য বহন করে। এই সংগ্রহ এক বিশাল সম্পদ। এর মাধ্যমে যুগে যুগে আরবি হস্তলিপির বিকাশ ও উন্নতি সম্পর্কে ধারণা মেলে। লাইব্রেরিতে থাকা সবচেয়ে প্রাচীন হস্তলিখিত কোরআনটির তারিখ লেখা আছে ৪৮৮ হিজরি। হরিণের চামড়ায় এটি লিখেছেন আলি বিন মোহাম্মাদ আল বাতলিওসি। এর নিকটবর্তীকালের কোরআনটি ৫৪৯ হিজরির, যা লিখেছেন আবু সাদ মোহাম্মাদ ইসমাইল বিন মোহাম্মাদ। গোলাম মহিউদ্দীনের হাতে লিখিত কোরআনটি এই গ্রন্থাগারের সবচেয়ে বৃহদাকারের, লেখার তারিখ ১২৪০ হিজরি, হস্তলিখিত এই কোরআনটির ওজন ১৫৮ কেজি। এছাড়া গ্রন্থাগারটিতে প্রায় ২৫ হাজার দুর্লভ কিতাবের বিশাল সংগ্রহের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ হাজার এমফিল ও পিএইচডি গবেষণা গ্রন্থ। দশ হাজারের বেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাসিক, ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক সাময়িকী।
মাকতাবাতু কারাউইন
মাকতাবাতু কারাউইন আফ্রিকার মরক্কোতে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন লাইব্রেরি। অসংখ্য মূল্যবান পা-ুলিপির সমাহার রয়েছে এখানে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- হরিণের চামড়ার ওপর ইমাম মালেক (রহ.)-এর হাতে লেখা মুয়াত্তার (হাদিস সংকলন) পা-ুলিপি, ১৬০২ সালে সুলতান আহমাদ আল মনসুরের দেওয়া কোরআনের কপি, সিরাতে ইবনে ইসহাক, ইবনে খালদুনের বই ‘আল-ইবার’র মূল কপিসহ আরও অনেক কিছু।
৮৫৯ সালে আরবের ধনাঢ্য নারী ফাতেমা আল ফিহরির ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফেজ নগরীর কারাউইন নামে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছরই মসজিদের আঙিনায় তিনি গড়ে তোলেন আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আল কারউইন বিশ্ববিদ্যালয় ও পাঠাগার। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৩৫৯ সাল পর্যন্ত একটানা চালু ছিল পাঠাগারটি। তবে বিভিন্ন সময়ের যুদ্ধে উপনিবেশবাদীদের দখল-বেদখলের ঘটনায় ফেজ শহর ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আল কারাউইন মোটামুটি অক্ষত ছিল। কখনো কখনো বন্ধ থেকেছে বিশাল এ জ্ঞানের ভাণ্ডার। কয়েক প্রজন্ম ধরে পাঠাগারের রক্ষীরা এসব মূল্যবান তথ্য-উপাত্ত রেখেছেন তালাবদ্ধ।
১৯১৩-৫৬ সাল পর্যন্ত ঔপনিবেশিক আমলে ফ্রান্স পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আরেকবার ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা ও সনদ বিতরণ বন্ধ করে দেয়। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সব রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৫৬ সালে মরক্কো স্বাধীনতা লাভ করার পর কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেন বাদশা মুহাম্মদ।
সম্প্রতি আল কারাউইন পাঠাগারকে বাঁচাতে নতুন পদক্ষেপ নেয় মরক্কোর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। পাঠাগারটিকে পুনরায় চালুর জন্য তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তারা নিয়োগ দেয় আজিজা চাউনি এবং তার স্থাপত্য দলকে। প্রকৌশলীরা পুনরায় ভবন নির্মাণ করে সবুজ রঙের ছাদের প্রতিটি টাইলস আগের মতো দৃষ্টিনন্দন রূপে তৈরি করেছেন।
মক্কা লাইব্রেরি
বিশ্বের নামিদামি পাঠাগারগুলোর মধ্যে মক্কা লাইব্রেরি অন্যতম। মক্কার সাফা ও মারওয়া থেকে পূর্বদিকে অবস্থিত পাহাড়ের পাদদেশে হলুদ বর্ণের একটি দ্বিতল ভবন। ঐতিহাসিকদের মতে এখানেই জন্মেছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নবীর জন্মস্থানটি স্মৃতিময় করে রাখতে ১৬০ হিজরিতে আব্বাসী খলিফা মাহদির শাসনামলে ভবনটির আমূল সংস্কার হয়। ১৩৫৭ হিজরিতে বাদশা আবদুল আজিজের শাসনামলে প্রথম এর নামকরণ করা হয় ‘মাকতাবাতুল হারাম আল-মাক্কি। ’
পরবর্তী সময়ে স্থান সংকুলান না হওয়া লাইব্রেরির বেশিরভাগ বই স্থানান্তর করা হয় মসজিদে হারামের চতুর্থ তলায় নির্মিত লাইব্রেরিতে। তবে নবী করিম (সা.)-এর বাড়িটি এখনো লাইব্রেরি হিসেবে সংরক্ষিত, এখানে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত।
স্থানান্তরিত লাইব্রেরিটি মসজিদে হারামের ‘বাদশাহ ফাহাদ’ গেট দিয়ে প্রবেশ করলে সহজে মেলে। বর্তমানে এটি সুবিশাল ও অত্যাধুনিক গ্রন্থাগার। বিন্যাস, সাজসজ্জা, ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলায় গ্রন্থাগারটি বেশ মনোরম। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থাগার হিসেবে পরিচিত। ১৩৭৫-১৩৮৫ হিজরি পর্যন্ত গ্রন্থাগারটি সৌদি হজ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ছিল। এরপর মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববির কার্যপরিচালনা পর্ষদকে এর দায়িত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে এটি একটি জেনারেল লাইব্রেরিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বিপুলসংখ্যক লেখক-পাঠক, গবেষক ও দর্শনার্থী আগমনে মুখরিত এর অঙ্গন। এ গ্রন্থাগারে বর্তমানে প্রায় ৩৫ হাজার গ্রন্থ রয়েছে। ১০টি মৌলিক ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে কিতাবগুলো রাখা হলেও পাঁচ হাজার ৬০০ উপ-ক্যাটাগরিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
গ্রন্থাগারটিতে সাত হাজার ৮৪৭টি মৌলিক আরবি পান্ডুলিপি রয়েছে। ৩৭৮টি অনারবীয় পান্ডুলিপি রয়েছে। ফটোকপি করা পা-ুলিপি রয়েছে আড়াই হাজারের মতো। এ ছাড়া অসংখ্য গবেষণা ও তথ্য-পুস্তিকা, পত্রিকা বিভাগে আধুনিক-প্রাচীন প্রচুর পত্রিকা রয়েছে। সমকালীন প্রকাশিত আরবি ও অন্যান্য ভাষার পত্রিকার পাশাপাশি বিশ্বের নানা দেশের পত্রিকা ও সাময়িকীও রয়েছে। কাগুজে সংগ্রহের পাশাপাশি আছে প্রায় ১২ হাজার অডিও সিডি ক্যাসেট ও ডাটা সংবলিত অডিও লাইব্রেরি। এতে বিখ্যাত আলেম-মনীষী, ইমাম-খতিব ও গবেষকদের বক্তব্যের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। এই লাইব্রেরির অন্যতম আকর্ষণ বাংলা, উর্দু, হিন্দি, তামিল, ফ্রেঞ্চ, চাইনিজ, তেলেগু, সিংহল, জার্মান, পশতু, মারাঠি, সোমালি, রুশ, আলবেনীয়সহ অন্য ভাষায় লিখিত বইয়ের সংগ্রহ। প্রায় সব বইয়ের বিষয়বস্তু ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মুদ্রিত বই ছাড়াও কিছু প্রাচীন, দু®প্রাপ্য হাতেলেখা পা-ুলিপি আছে এখানে। মক্কা লাইব্রেরি সাধারণ পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত। যেকোনো আগ্রহী পাঠক এখানকার মনোরম পরিবেশে এসে অধ্যয়ন করতে পারেন। এখানে রয়েছে প্রশিক্ষণ বিভাগ, ইলেকট্রনিক লাইব্রেরি বিভাগ, মাইক্রোফিল্ম বিভাগ, ফটো মাইক্রোফিল্ম বিভাগ, হারামাইন স্টল, নারী বিভাগসহ আরও অনেক সুবিধা।
তেহরান বুক গার্ডেন
বিশ্বের নামিদামি সব লাইব্রেরিকে পেছনে ফেলে মোট এক লাখ ১০ হাজার বর্গমিটারের বিশাল জায়গা নিয়ে ইরানের রাজধানী তেহরানে নির্মিত হয়েছে তেহরান বুক গার্ডেন। এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তেহরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আব্বাসাবাদ হিলসে নির্মিত এই লাইব্রেরিতে বইয়ের দৃষ্টি আকর্ষক প্রদর্শনীর সঙ্গে রয়েছে একটি আর্ট গ্যালারি। শিশুদের জন্য বিশেষ সেকশন, যেখানে রয়েছে শুধু শিশুতোষ বই। নিউজ উইকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু শিশুদের জন্যই রয়েছে চার লাখ বইয়ের বিশাল সংগ্রহ। এই লাইব্রেরিতে আরও রয়েছে মুভি থিয়েটার, সায়েন্স হল, ক্লাসরুম, একটি রেস্টুরেন্ট এবং একটি নামাজঘর। আর মনোরম পরিবেশে পড়ার জন্য লাইব্রেরির ছাদে রয়েছে সবুজ পার্ক।
২০১৭ সালের জুলাইয়ে উদ্বোধনের সময় তেহরানের মেয়র মোহাম্মদ বাকার কালিবাফ বলেছিলেন, এটি আমাদের দেশের জন্য একটি বড় সাংস্কৃতিক আয়োজন। এই সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক সুযোগ গ্রহণ করে শিশুরা যথাযথভাবে বেড়ে উঠবে। তেহরান বুক গার্ডেন প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রস্তাব এসেছিল ২০০৪ সালে। তেহরান আন্তর্জাতিক বইমেলার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কারণে এই প্রস্তাবটি আসে।
গিনেজ বিশ্ব রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালের পর থেকে বিশ্বের সব থেকে বড় লাইব্রেরি হচ্ছে নিউ ইয়র্ক শহরের ফিফথ এভিনিউয়ের বার্নেস অ্যান্ড নোবেল। এটি প্রায় এক লাখ ৫৪ হাজার স্কয়ার ফিট জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। যেখানে ১২ মাইল দীর্ঘ জায়গাজুড়ে বই রাখার জন্য ব্যবহৃত সেলফ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই লাইব্রেরি থেকে তেহরান বুক গার্ডেন প্রায় তিনগুণ বড়।
মাকতাবাতু জামেয়া আজহার
শায়খ আবদুহুর তত্ত্বাবধানে ১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি। বর্তমানে এখানে দুই লাখের বেশি বই রয়েছে। এ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে প্রাচীন ও দুর্লভ সব বই ও পা-ুলিপি। বিশেষ করে হিজরি নবম শতাব্দী ও তার পরবর্তী যুগের পা-ুলিপির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি সংরক্ষিত। ২০০৫ সালে এখানকার পা-ুলিপির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০ হাজারে। ৬৩টি শাস্ত্র ও বিষয়ে বর্তমানে ৪৫০ আধুনিক শেলফসমৃদ্ধ ৩১৮টি হলরুম আছে লাইব্রেরিটিতে। আছে ৭৪টি কম্পিউটার। রয়েছে আলাদা প্রকাশনা বিভাগ, ২৬টি নিজস্ব প্রেস মেশিন। চার মাজহাবের ফিকহ-হাদিস-ইতিহাস, তাফসির, সিরাত, আধ্যাত্মিকতা, ভাষা-সাহিত্য, বালাগাত ও অলংকার, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থ, রাজত্ব ও বাদশা নামদারদের কথনসহ বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ আছে এখানে।
মাকতাবা দারুল উলুম দেওবন্দ
১৮৬৬ সালের ৩১ মে ভারতের সাহরানপুর জেলার দেওবন্দ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা। কয়েক বছর পর ছাত্রদের পড়াশোনার সুবিধার জন্য গঠন করা হয় নিজস্ব পাঠাগার। মাদ্রাসার পুরাতন দারুল হাদিসের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দ্বিতীয় তলায় এর অবস্থান। পাঠাগারটি প্রথমে ছোট পরিসরে হলেও এখন এতে রয়েছে বিপুল পরিমাণে কিতাবের সমাহার। এমন কোনো বিষয় বাদ নেই, যার অন্তত একটি কিতাব বা পা-ুলিপি নেই এখানে। আনুমানিক লক্ষাধিক বই রয়েছে পাঠাগারটিতে। বাদশাহ আলমগীরের হাতে লেখা একটি কিতাবও আছে। আছে বিভিন্ন বিষয়ের নকশাসমৃদ্ধ দেয়ালিকা। পাঠাগারটি ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত। এই পাঠাগারে কাচের বাক্সে রয়েছে হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর হাতে লেখা দুটি ভিন্ন রকম চিঠি। রয়েছে নুকতাবিহীন পূর্ণ কোরআনের তাফসির ‘সাওয়াতিহুল আলহাম’-এর কপি। আরও আছে হিন্দু ধর্মের ঋগে¦দ, রামায়ণ, ইঞ্জিল শরিফ ও জাবুর শরিফের পুরনো কপি।
রামপুর রাজা লাইব্রেরি
দিল্লির সুলতান আমল এবং মুঘল শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারের কথা অনেকেরই জানা। তবে বর্তমান উত্তর প্রদেশের রামপুর যখন মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল, তখন সেখানকার নবাব সাইয়েদ মুহাম্মদ সাইদ খান কর্র্তৃক প্রতিষ্ঠিত এক রাজকীয় গ্রন্থাগারে বইয়ের সংগ্রহ আজও অবাক করে গবেষকদের। এটি এশিয়ার বৃহত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর গ্রন্থাগার। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতজুড়ে বেশ কয়েকটি স্বাধীন রিয়াসত (জমিদারি) প্রতিষ্ঠিত হয়, রামপুরের রিয়াসত তার একটি। এখানকার অধিকর্তা নবাব ফয়জুল্লাহ খানের সময়ে রামপুরে একটি কুতুবখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু হয় বইপত্রের অনুবাদ ও অনুলিপি প্রস্তুতের কাজ। নবাব সাইয়েদ মুহাম্মদ সাইদ খানের শাসনামলে (১৮৪০-৫৫) গৌরবপ্রাপ্ত এই রাজকীয় গ্রন্থাগারের নাম ছিল ‘কুতুবখানা রিয়াসত-ই-রামপুর। ’ ওই সময় এই কুতুবখানার জন্য এক হাজার চারশ স্বর্ণমুদ্রার বই কেনা হয়। হুমায়ুননামা, আকবরনামা, খাজানাতুল আলম, তারিখে নাদেরি, খোলাসাতুত তাওয়ারিখ, তারিখে জাহান খফি ও তারিখে মজমায়ে মাহফিল ইত্যাদি ঐতিহাসিক বিভিন্ন গ্রন্থ ওই কুতুবখানায় ছিল। বংশপরম্পরায় নবাব সাইয়েদ মুহাম্মদ ইউসুফ, নবাব কলব আলী খান, নবাব হামিদ আলী খানরা এই কুতুবখানার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন। তাফসির, হাদিস, আসমাউর রিজাল (হাদিস বর্ণনাকারীদের জীবন চরিত) ফিকাহ, উসুলে ফিকাহ, ইলমুল কালাম, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, সাহিত্য, অলংকারশাস্ত্র, অভিধান ও নাহু-সরফসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর যোগ হতে থাকে। এই গ্রন্থাগারে ১৮৭৯ সালে ৯৩৪৭টি এবং ১৯২৭ সালে ২৪,১১৭টি বই থাকার তথ্য পাওয়া যায়। বর্তমানে এখানে বইয়ের সংখ্যা লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে ১৫ হাজার বিরল পা-ুলিপি রয়েছে। এই গ্রন্থাগারের সংগ্রহশালায় থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ হলো- হজরত আলি (রা.)-এর হাতে লেখা কোরআনের একটি কপি ও উর্দু ভাষায় পবিত্র কোরআনের প্রথম অনুবাদের আসল পা-ুলিপি। এছাড়া সংস্কৃত, উর্দু, পশতু, তামিল ভাষার বহু বই রয়েছে এই গ্রন্থাগারে।
ভারত স্বাধীনের পর একটি ট্রাস্ট গঠন করে তাদের হাতে এই গ্রন্থাগারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সেই ট্রাস্টই এই গ্রন্থাগার পরিচালনা করত। ১৯৭৫ সালের জুলাই থেকে ভারত সরকার এই গ্রন্থাগারের দায়িত্ব নেয়। সংস্কৃতি বিভাগের অধীনে এই ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থাগার পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে এর নাম রামপুর রাজা লাইব্রেরি। এর রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে সমস্ত খরচ দেয় ভারত সরকার।
ভয়েস/আআ